লেখক পরিচিতি
অজয় দাশগুপ্ত
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জনপ্রিয় কলাম লেখক
বদলে যাচ্ছে দেশ, বদলে গেছে রাজনীতি। আগে রাজনীতির কথা বলি। তার বদলানো আসলেই কি নতুন কিছু? দেশ স্বাধীনের পর পর আমরা হোঁচট খেয়েছিলাম ভুট্টোর আগমনে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসতেই পারেন। একবার যুদ্ধ হলেই কোনো দেশ চিরকালের দুশমন হয়ে যায়, তেমন না-ও হতে পারে। তবে পাকিস্তানের ব্যাপারে সেটা ঠিক নয়। তারা এখন অবধি আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের মতো সেদেশে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না যার প্রগতিবাদের প্রতি কমিটমেন্ট সবসময় একধরনের।
লেখক উদ্বৃতি :দেশ মুক্ত হওয়ার পরপর ঢাকায় আসা এই বাংলাদেশবিরোধী পাকিস্তানির জন্য দরদ উথলে উঠেছিল কিছু মানুষের। রাজপথে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আর মনে মনে দোয়া দিয়ে পথ ভাসানো পাকিদরদীরা আসলে তখন থেকেই সক্রিয়।
এই লেখা যখন লিখছি, দেখলাম, হামিদ মীর নাকি তার পিতাকে দেওয়া বর্তমান সরকারের সম্মাননা ফেরত দেবেন। বুঝুন এবার। হতে পারে এই সম্মাননার কারণে তিনি তার দেশে নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারবেন না। আবার এ-ও হতে পারে এখন তার মনে হচ্ছে বাংলাদেশিদের দেওয়া সম্মাননা ‘না-জায়েজ’। এই হল পাকিস্তান।
বলছিলাম ভুট্টো সাহেবের কথা। দেশ মুক্ত হওয়ার পরপর ঢাকায় আসা এই বাংলাদেশবিরোধী পাকিস্তানির জন্য দরদ উথলে উঠেছিল কিছু মানুষের। রাজপথে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আর মনে মনে দোয়া দিয়ে পথ ভাসানো পাকিদরদীরা আসলে তখন থেকেই সক্রিয়।
সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে এরা সুবিধা করতে না পারলেও আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেক্যুলার সরকারপ্রধান তাজউদ্দীনকে অবহেলা করেছিল নির্মমভাবে। তাঁর প্রজ্ঞা-মেধা-দূরদর্শিতা ব্যবহার করতে পারলে হয়তো অনেক বিপদ এড়ানো সম্ভব হত।
এর ফাঁকে বেড়ে ওঠা পাকিদরদী চক্র মোশতাকের হাত ধরে প্রথম সামনে এলেও আওয়ামী লীগ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে জিয়াউর রহমানকে যত বড় শত্রু মনে করে, মোশতাককে হয়তো তত বড় দুশমন মনে করে না। অথবা দলের কলঙ্ক বলে তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু বাস্তবতা এই খন্দকার মোশতাকই বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর সরকার গঠন করে খুনিদের ‘সূর্যসন্তান’ ডেকেছিল। সেই থেকে রাখঢাকের রাজনীতিতে ঢুকে পড়া আওয়ামী লীগও এখন পরিবর্তনের শিকার।
এদেশের মানুষের মন বোঝা কঠিন কিছু না। আসলে আমরা বলতে চাই না। কারণ বললে আমরা ছোট হয়ে যাই। জিয়াউর রহমানের স্বল্পকালীন শাসন কি এত প্রতাপ আর সাহস রাখে যে দেশ পাল্টে দিতে পারে? মূলত মানুষের মনে মনে ‘পাকিস্তান প্রেম’ আগে থেকেই বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল। তারা সুযোগের সন্ধানে ছিল মাত্র।
সেই সময় থেকে আজ অবধি আওয়ামী লীগের সমর্থন কমে-বাড়ে, কিন্তু বিএনপির কমে না। কারণ বিএনপি জামায়াতও না, আবার বামও না। দেশের মধ্যবিত্তের মনে মুসলিম মনোভাব প্রবল বলে তারা বাঙালি হতে দ্বিধান্বিত। অথচ বাঙালি না হলে পহেলা বৈশাখে যাওয়া যায় না। শহীদ মিনারে যাওয়া যায় না। শোভাযাত্রায় সামিল হওয়া যায় না।
"নিন্দুকের বলে মোটা অংকের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় নাকি হেফাজতের একাংশ আওয়ামীমুখী। আবার এ-ও বলা হয় হেফাজত এই সরকারের আমলেই জামায়াতের বিকল্প হতে চায়। হতে চাওয়াটা অন্যায়ের কিছু নয়। কিন্তু আপত্তি থাকে তাদের মত ও পথের বিবেচনায়। যে ১৩ দফা তাদের, আদর্শ কি আছে সেখানে? ভালো করে দেখুন– ১৩ দফা জামাতের চেয়েও ভয়াবহ। অথচ তারা এখন দেশের সমঝোতার রাজনীতিতে চমৎকার জায়গায়। কথা হচ্ছে এই সমঝোতা কি আওয়ামী লীগকে আসলে নিরাপদে রাখবে?'"
জামায়াতের আদর্শ ভালো লাগলেও তারা কট্টর জীবনযাপন মানতে পারেন না। তাদের চাই জিন্নাহ সাহেবের মতো জীবন। ধর্মের নামে রাজনীতি ও সমাজকে বশে রেখে নিজে পানাহার করতে হবে। স্যুট-কোট-টাই পরা ছাড়বে না। নিজেরা দিল্লি যাবে। ভারতে শপিং করবে, ডাক্তার দেখাবে, কিন্তু জনগণকে করা হবে মৌলবাদী ও ইসলামাবাদমুখী।
জিয়াউর রহমানের আমলে কর্নেল ওসমানী হেরেছিলেন ভোটে। মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সিপাহসালারকে সেভাবে মূল্যায়ন করেনি। কেন করেনি? কারণ তারা তখন থেকেই বদলে যাচ্ছিল। বদলে না গেলে হাফেজ্জি হুজুর কীভাবে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন মানুষের ভোটে? শাহ আজিজ কি কেবল কারো দয়ায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন? মানুষ তাকে নেয়নি? বদলে যাওয়া বাংলাদেশে মাওলানা মান্নান থেকে নিজামী বা হেফাজতের হুজুর সবাই জায়েজ।
এই রাজনীতির ফল এতদিন বিএনপি একা খেলেও এখন আর তা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ বুঝে গেছে তারা আসলে ‘মাইনরিটি’। ভোটের অংকে তারা ৪০ ভাগও না। বাকি ৬০ ভাগ আওয়ামীবিরোধী। এই সমীকরণে পাওয়ারে থাকতে হলে সমঝোতার বিকল্প আছে?
নিন্দুকের বলে মোটা অংকের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় নাকি হেফাজতের একাংশ আওয়ামীমুখী। আবার এ-ও বলা হয় হেফাজত এই সরকারের আমলেই জামায়াতের বিকল্প হতে চায়। হতে চাওয়াটা অন্যায়ের কিছু নয়। কিন্তু আপত্তি থাকে তাদের মত ও পথের বিবেচনায়। যে ১৩ দফা তাদের, আদর্শ কি আছে সেখানে? ভালো করে দেখুন– ১৩ দফা জামাতের চেয়েও ভয়াবহ। অথচ তারা এখন দেশের সমঝোতার রাজনীতিতে চমৎকার জায়গায়। কথা হচ্ছে এই সমঝোতা কি আওয়ামী লীগকে আসলে নিরাপদে রাখবে?
মনে পড়ছে সেই ভয়াবহ দিনরাতের কথা। হেফাজতের শাপলা সমাবেশ নিয়ে কিছু মিডিয়ার মাতম। অাজ যিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত সেই এরশাদ সাহেব পানি পান করানোর দায়িত্ব নিয়ে গুনাহ মওকুফের পাশাপাশি সরকার পতনে সমর্থন দিয়েছিলেন। বিএনপি তো মানুষকে ঘর থেকে বেরুনোর ডাক দিয়ে দিয়েছিল। সেই রাতে নিরাপত্তা বাহিনী আর প্রধানমন্ত্রীর সাহস একত্রিত না হলে কী হত, বলা মুশকিল। এর পরপর তখনকার আওয়ামীলীগ শপথ আর আজ ভাস্কর্য সরানোর সমঝোতার সমীকরণ মেলে না। বরং কেন জানি মনে হয়:
“তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।”
এটা নিশ্চিত দেশের বেশিরভাগ মানুষের মন বুঝে আওয়ামী লীগ মত বদলেছে। তবে এটা মনে রাখা দরকার বাজারে দুধ থাকলে তার ভক্তেরা ঘোল গিলবে না। জামায়াত-বিএনপি-হেফাজত একাকার হলে মিলে যায়। আওয়ামীলীগ সেখানে ‘মিসফিট’।
তবে এটা বুঝতে পারছি কৌশলে বাগে রাখার রাজনীতি চলছে। দড়ি শিথিল হলে বা শেখ হাসিনা গেলেই গণভোটের মতো কিছু একটা হয়ে পতাকা যাবে। জাতীয় সঙ্গীত ‘হারাম’ হবে! দেশের নাম কী হবে, কেউ বলতে পারে না! সে চক্রান্ত না রুখে আপস মানে মুক্তিযুদ্ধকে বিপদে ফেলে দেওয়া। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া দল যদি তা করে এদেশে বাম ডান কেউই নিরাপদ থাকবে না।
বেশ কয়েক বছর আগে বহুল প্রচারিত ঘোর আওয়ামী বিরোধী দৈনিকটি স্লোগান দিয়েছিল: ‘বদলে যাও, বদলে দাও।’
এখন আওয়ামীলীগও তার শিকার। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘আওয়ামী লীগ’এ রূপান্তরিত দল এখন আবার উল্টো রথে। বদলে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ভীত দেশ দেখছে, দেখছেন বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন ও প্রয়াতেরা।
সামনে কী আছে কেউ জানে না। শুধু খোলস বদলালেই কি সমাজ বদলায়, না দেশ?
Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত