সমাজতন্ত্র ছাড়া গণতন্ত্র একটি ‘পোড়া রুটি’



পৃথিবীতে রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনায় শ্রমিক-গরিবদের অধিকার রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারের নাম সমাজতন্ত্র। যেসব দেশে সমাজতন্ত্রের সরকার নেই, সেসব দেশেও সমাজতন্ত্রের মন্ত্রই শ্রমিক-গরিবদের অধিকার ভোগের সুযোগ করে দেয়। মার্কস-অ্যাঙ্গেলস-লেনিন-মাও সেতুং সবাই সমাজতন্ত্র দর্শনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাদের মূল কথা, সমাজতন্ত্র হচ্ছে বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ করে সাম্যের পথে এগিয়ে চলা। যিনি বাস্তব অবস্থা বুঝে বাস্তবতার নিরিখে তা বিশ্লেষণ করার দক্ষতা রাখেন, তিনিই সমাজতন্ত্রের কর্মী হতে পারেন।

উদ্ধৃতি: কেউ কেউ বলেন, সমাজতন্ত্রের দিন শেষ, বাজার অর্থনীতির দিন শুরু। আমি বলি, সমাজতন্ত্রের নামে যারা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে দেশ পরিচালনা করেছে, তাদের ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। ওয়াদাভঙ্গের কারণে জনগণ তাদের হটিয়ে দিতে পারে। দোষ তাদের, সমাজতন্ত্রের নয়। ঠিক যেমন, শিশু যদি লেখাপড়া না শিখতে পারে তবে তা বাবা-মা, সমাজ ও রাষ্ট্রের ত্রুটি, শিশুর দোষ নয়। এ কারণেই রাশিয়াতে যদি সমাজতন্ত্র না থাকে, তবে সে দায় তাদের সরকারের, সমাজতন্ত্রের নয়। কারণ সমাজতন্ত্র সব সময় বাস্তবতার কথা বলে।

সমাজতন্ত্র বুঝতে বড় ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। বুঝতে চাইলেই এটা সহজ। যেমন, ঢাকা শহরে উঁচু দালান-কোঠা আছে, তেমনি আছে বস্তিও। রাস্তায় শুধু মোটরগাড়ি নয়, ঠেলাগাড়িও চলে। সমাজতন্ত্রীরা এই বাস্তব মানবে এবং এ বৈষম্য থেকে মুক্তি খুঁজবে। আর যিনি এটা মানবেন না বা মানলেও নাক উঁচু করে বলবেন, ঢাকায় শুধু দালান থাকবে আর সব বস্তি পাঠিয়ে দিতে হবে ঐ দূরে, তিনি হয় পাগল না-হয় স্বার্থপর। আর সমাজতন্ত্রীরা কী বলবে? বলবে, বস্তিবাসীদের জন্যও দালানের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা এটা করতে চান না, তারা স্বৈরাচারী, অত্যাচারী, শোষক, বঞ্চক ও স্বার্থপর। দেখেও না দেখার ভান করা তাদের মজ্জাগত।

কেউ কেউ বলেন, সমাজতন্ত্রের দিন শেষ, বাজার অর্থনীতির দিন শুরু। আমি বলি, সমাজতন্ত্রের নামে যারা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে দেশ পরিচালনা করেছে, তাদের ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। ওয়াদাভঙ্গের কারণে জনগণ তাদের হটিয়ে দিতে পারে। দোষ তাদের, সমাজতন্ত্রের নয়। ঠিক যেমন, শিশু যদি লেখাপড়া না শিখতে পারে তবে তা বাবা-মা, সমাজ ও রাষ্ট্রের ত্রুটি, শিশুর দোষ নয়। এ কারণেই রাশিয়াতে যদি সমাজতন্ত্র না থাকে, তবে সে দায় তাদের সরকারের, সমাজতন্ত্রের নয়। কারণ সমাজতন্ত্র সব সময় বাস্তবতার কথা বলে। সেটা কেমন?

সমাজতন্ত্রের সরকার থাকুক, না থাকুক, শতবর্ষ আগের সেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কারণেই শ্রমিকেরা পেয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার; নারীরা পেয়েছে ভোটের অধিকার; কৃষক পেয়েছে তার ফসলের অধিকার। তাই পথে-প্রান্তরে আমাদের প্রত্যেককে আজ থেকে একটি প্রশ্ন উচ্চারণ করতে হবে, ‘স্বাধীন বাংলায় গরিব কেন’।

সেটা হল এই যে, সমাজে কারও কম, কারও বেশি থাকতে পারে, কিন্তু বৈষম্য বা দারিদ্র্য থাকতে পারবে না। যার বেশি আছে সে যেমন বহু পদ দিয়ে ভাত-রুটি খেতে পারে, তেমনি যার কম আছে সে-ও যেন বহু পদ না হলেও পুষ্টিগুণসম্পন্ন পদ দিয়ে ভাত-রুটি খেতে পারে সমাজতন্ত্র তা নিশ্চিত করতে বলে।

আমেরিকার বাজার অর্থনীতির সরকারও শ্রমিকের মজুরি আর খাবারের দাম এমনভাবে রেখেছে যাতে শ্রমিকরাও সব সময় পেটপুরে তৃপ্তি করে খেতে পারে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী থাকতে পারে। আমাদের দেশের শ্রমিক-গরিবরাও তাদের আয় দিয়েই পুষ্টিকর সকল খাবার যাতে খেতে পারেন, খাবারের দাম যাতে তেমন থাকে, সেটাই সমাজতন্ত্রের কথা। অর্থাৎ,


কেউ খাবে, তো কেউ খাবে না– তা হবে না, তা হবে না।
কেউ দালানে, কেউ গাছতলায়– তা হবে না, তা হবে না।
কেউ লেখাপড়া শিখবে, কেউ শিখবে না– তা হবে না, তা হবে না।
কেউ কাজ পাবে, কেউ পাবে না– তা হবে না, তা হবে না।

সবাই খাবে, সবাই পরবে, সবাই লেখাপড়া শিখবে, সবাই ভালো ঘরে থাকবে, সবাই কাজ পাবে। কেউ অনাহারে থাকবে না, শিক্ষা ছাড়া থাকবে না, ঘরহীন থাকবে না, বেকার থাকবে না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে তাকালে আমরা দেখি, ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আর আমাদের এখনকার প্রশ্ন হচ্ছে, ‘স্বাধীন বাংলায় গরিব কেন’। এই প্রশ্ন আমাদের সেই বাস্তবতার মুখোমুখি করে, যে বাস্তবতায় এখনও কৃষক-শ্রমিক-মজুর-গরিব-নারী-শিশুর অধিকার ও মর্যাদার কমতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের। এ কারণেই অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য এখনও প্রাসঙ্গিক। অক্টোবর বিপ্লবই এই মেহনতী মানুষের অধিকার, মর্যাদা আর স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করেছে সমগ্র বিশ্বের রাজনীতিতে। অসমতার বিরুদ্ধে জনতার আন্দোলন জাগিয়ে রেখেছে, সমতার সমাজ গড়ার মন্ত্র যুগিয়েছে এই বিপ্লব।

সমাজতন্ত্রের সরকার থাকুক, না থাকুক, শতবর্ষ আগের সেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কারণেই শ্রমিকেরা পেয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার; নারীরা পেয়েছে ভোটের অধিকার; কৃষক পেয়েছে তার ফসলের অধিকার। তাই পথে-প্রান্তরে আমাদের প্রত্যেককে আজ থেকে একটি প্রশ্ন উচ্চারণ করতে হবে, ‘স্বাধীন বাংলায় গরিব কেন’।

আর এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে, তিরিশ লাখ শহীদের রক্তে লেখা এদেশের সংবিধানে যে সমাজতন্ত্রের কথা রয়েছে, তা সংবিধানের পাতা থেকে জীবনের পাতায় আনতে হবে আমাদের। কারণ কৃষক-শ্রমিক-মজুর-গরিব-নারী-শিশুর অধিকার ও মর্যাদা বাস্তবায়ন ছাড়া গণতন্ত্র একটি ‘পোড়া রুটি’। পোড়া রুটি খাওয়া যায় না। ভালো রুটি চাই। সম কাজে সম মজুরি চাই। সমাজতন্ত্রই বৈষম্য-দারিদ্র্য-ক্ষুধামুক্ত সমাজ তৈরির পথের দিশারী আর অসম বিশ্বায়নে সমতা আনার চাবিকাঠি। কারণ কৃষক-শ্রমিক-মজুরই এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

মনে রাখতে হবে, এ জন্য প্রয়োজন দেশে স্থায়ী শান্তি। আর জঙ্গি-স্বৈরাচারী-রাজাকার ও তাদের দোসররা যেমন শান্তির শত্রু, মানুষের সমান অধিকারের শত্রু, তেমনি সমাজতন্ত্রেরও। তাই এদেরকে রাজনীতি ও ক্ষমতার বাইরেই রাখতে হবে। সে কারণে যতক্ষণ না বৈষম্য-দারিদ্র্য-ক্ষুধামুক্ত সমাজ তৈরি হবে, ততক্ষণ সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা হাতে জাসদের লড়াই চলবে। জঙ্গিদমনের যুদ্ধেও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) থাকবে সামনে।

জয় বাংলা। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত



Inu

লেখক পরিচিতি

হাসানুল হক ইনু
হাসানুল হক ইনু একজন বামপন্থী (মস্কোপন্থী) রাজনীতিবিদ এবং সেই সাথে তিনি একজন লেখক।