একজন মুক্তিযোদ্ধা বেলায়েত



দুই নম্বর সেক্টরটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ দু:সাহসীদের সমাবেশ। অসামান্য মেধা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর অকুতোভয় সাহসের মিশেলে গড়া বেশ কিছু অভাবনীয় সাহসী মানুষ জড়ো হয়েছিল এই সেক্টরে। সুবেদার বেলায়েত সেই তুলনা ছিল খুবই সাধারণ। হাসিখুশী সরল সাধাসিধে মানুষটা খুবই বিশ্বস্ত ছিল, সবার সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারতো। বাড়ি ছিল সন্দীপ, বাড়ি ফেলে আসা বউ আর ছেলেমেয়ের কথা প্রায়ই বলতো। সেই মানুষটা হঠাৎ একদিন এক রূপকথার জন্ম দিয়ে বসলো।

উক্তি:“দেশ মাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ: তুমুল সে যুদ্ধে অসমসাহসে লড়তে লড়তে শহীদ হয়েছিল সুবেদার বেলায়েত, বুকের তাজা রক্তে ভেসে গিয়েছিল বাঙলা মায়ের পবিত্র আঁচল, কিন্তু তার ঠোঁটে লেগে ছিল সেই অকৃত্রিম হাসিটুকু।”

শালদা নদী অঞ্চলটা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের জন্য মৃত্যুপুরী। ওদের তুলনায় আমাদের অস্ত্র ছিল যৎসামান্য, তাও অনেক পুরাতন, কিন্তু আমাদের যোদ্ধারা ছিল সব তারছিঁড়া ক্রাক, মৃত্যুকে থোরাই কেয়ার করতো। রোদ-বৃষ্টি-কাদা-ঘুটঘুটে আঁধার, কিছুই দমাতে পারত না ওদের। সেদিন সকালে চারটা কোম্পানি মিলে একসাথে অ্যাটাক করার কথা ছিল নদীর ওইপাড়ে, বড় বড় বাংকার খুঁড়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছে যেখানে পাকিস্তানীরা। অ্যাটাক হলো, জবাব এলো যথারীতি প্রচণ্ড বেগে। একের পর এক মর্টার শেল পড়ছে, সালদা নদীর কাছে সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট জামিলের চার্লি কোম্পানিতে যুদ্ধ করতে থাকা বেলায়েতের পাশে হঠাৎ ঢলে পড়ল তার এক বন্ধু, গুলিটা কপাল ভেদ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। মুহূর্তের জন্য বেলায়েত নিশ্চল পাথর হয়ে গেল। ন্যাংটোকালের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মৃতদেহ কোলে নিয়ে স্তব্ধ বেলায়েতের পৃথিবীটা যেন থমকে গেল হঠাৎ।ওই এক মুহূর্তই, এরপর হঠাৎ করেই ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়াটারের ওয়াকিটকিটা ভয়ংকর ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বেলায়েতের হাসিখুশি গলাটা কেমন যেন পাথরকঠিন শোনালো, ‘স্যার, নদীর ওইপারের সব কয়টা বাংকার উড়ায়া দিয়া আসি, পারমিশন দেন স্যার।’ বারবার একই অনুরোধ, একটাবার অনুমতি দেন স্যার। ক্যাপ্টেন গাফফার আগরতলায় যাবেন, জরুরি মিটিং, এর মধ্যে বেলায়েতের এই বিচিত্র আবেদন, নদীর ওই পাড়ে এত শক্তিশালী একটা স্টাব্লিশমেন্ট সে নাকি একলা উড়ায়া দিয়া আসবে! কী অদ্ভুত কথা, শোনো তো… হঠাৎ করেই গাফফারের বিরক্তিমাখা গলা শোনা গেল, ঠিক আছে, যাও। গুডলাক। কয়েকটা সেকেন্ড নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না বেলায়েত, স্যার পারমিশন দিয়ে দিয়েছেন! ঈদের চাঁদ দেখলেও সে এতোটা খুশী হত কিনা সন্দেহ আছে। কাউকে নড়ার সুযোগ না দিয়ে রিকয়েলেস রাইফেলটা একাই তুলে সামনে এগোল বেলায়েত, সবার বিস্ময়াভিভূত চোখের সামনে একলাই ওপেন করলো ফায়ার, এন্টি ট্যাংক শেলিং-এ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরিত হলো ওপাশের দুটো বাংকার!

তারপরের দুই ঘণ্টা যা হলো, সেটা পাকিস্তানীরা তো দূরে থাক, বেলায়েতের সহযোদ্ধারা পর্যন্ত কল্পনা করতে পারেননি। পাকিস্তানীরা ভেবেছিল, প্রতিদিনের রুটিন গোলাগুলির অংশ এইটা, কিন্তু বেলায়েত ক্ষেপে যাওয়ায় সব হিসেব এলোমেলো হয়ে গেল। মাথার উপর দিয়ে সাই সাই করে ছুটে যাওয়া বুলেটের পরোয়া না করে বেলায়েতকে এইভাবে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে সহযোদ্ধারা নতুন উদ্যমে ফায়ার করতে শুরু করল। আচমকা এই ভয়ংকর তাণ্ডবে দিশেহারা হয়ে অস্ত্র তুলতে ভুলে গেল অনেক পাকিস্তানী হানাদার, পালাতে থাকলো দিগবিদিক। সেই দৃশ্য দেখে আরো উৎসাহে গুলি করতে করতেই নদী পার হলো বেলায়েত আর অগ্রবর্তী বাহিনী, তারপর ভীমমূর্তিতে চার্জ করতে শুরু করলো একের পর এক বাংকার প্রবল প্রতাপে। গ্রীক পুরাণে হারকিউলিসের নাম হয়তো শুনে থাকবে পাকিস্তানীরা, অসম্ভব শক্তির সেই দেবতার অকল্পনীয় সব বীরত্বগাঁথা দেখার অপূর্ণ ইচ্ছেটাও বোধহয় পূরণ হয়ে গেল তাদের সেদিন। মেজর ডাঃ আখতার সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা বর্ণনা করেছেন এভাবে,

‘দেখলাম, কণ্ঠ দিয়ে গর্জন বেরুচ্ছে, যেন একটা স্টিম রোলারের মতো পাকিদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে বেলায়েত, পিষতে পিষতে…’.

লাঞ্চের আগেই সালদা নদী ষ্টেশনের শক্তিশালী ঘাঁটি দখলে চলে এল মুক্তিযোদ্ধাদের, কেবল প্রাণটা হাতে নয়নপুরের দিকে পালিয়ে গেল পাকিস্তানীরা। বাংকারগুলোর ভেতর ঢুকে দেখা গেল, চুলার পাশে আঁটাগুলো গোল গোল করে পাকানো পড়ে আছে, চুলোর আগুন জ্বলছে তখনো, থরে থরে অস্ত্র আর গ্রেনেড সাজানো, কেবল জানটা হাতে নিয়ে পালিয়েছে ওরা, পেছনে ফিরে তাকাবার সাহস হয়নি, যারা মরেছে, তাদের নিষ্প্রাণ চোখে তখনো বিস্ময় লেগে আছে, কী অমিত তেজ, কী ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস… সালদা নদী ষ্টেশন ঘাঁটিটা দখলের তিনদিনের মাথায় পুনর্দখল নিতে পাকিস্তানীরা দ্বিগুন শক্তিতে হামলা চালায়। প্রবল প্রচণ্ড সে যুদ্ধে শহীদ হন সুবেদার বেলায়েত। ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটা কোম্পানী, ভারতীয় মিডিয়াম আর্টিলারির এত এত সেনা মিলেও যে ঘাঁটি দখল করতে পারেনি, সুবেদার বেলায়েতের হারকিউলিসের মতো অভূতপুর্ব বীরত্বে সেই ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এসেছিল মাত্র দুই ঘণ্টায়। কোনমতে প্রানটা হাতে ইদুরের বাচ্চার মত পালিয়ে যাওয়া পাকিস্তানীদের ভয়ংকর ক্ষোভ ছিল ওঁর উপর, তাই তিন দিনের মাথায় নয়নপুর ঘাঁটি থেকে চালানো হামলায় ফার্স্ট প্রায়োরিটি ছিল বেলায়েতকে হত্যা। তুমুল সে যুদ্ধে অসমসাহসে লড়তে লড়তে শহীদ হয়েছিল সুবেদার বেলায়েত, বুকের তাজা রক্তে ভেসে গিয়েছিল বাঙলা মায়ের পবিত্র আঁচল, কিন্তু তার ঠোঁটে লেগে ছিল সেই অকৃত্রিম হাসিটুকু। শহীদ সুবেদার বেলায়েত হোসেন বীর উত্তম হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছিল, আমাদের বেলায়েত… যার বীরত্বের কাছে হারকিউলিসও কিছু না… কিচ্ছু না!

Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত



Rahaman-Raad

লেখক পরিচিতি

রহমান রাদ
রহমান রাদ একজন জনপ্রিয় লেখক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখনীতে তার বিশেষ কৃতিত্ব আছে। তিনি অনেক সময় ধরে ইন্টারনেট এ নতুন প্রজন্মকে তার বিশেষ লেখনীর মাধ্যমে উৎসাহিত করে আসছেন।।