লেখক পরিচিতি
বিজন সরকার
বিশিষ্ট ভাষা গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।
প্রতিবেশী ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ। আমাদের দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের ভৌগলিক অবস্থান ও ডেমোগ্রাফিক চরিত্রের প্রভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিগত কয়েক দশকে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির মতো কিংবা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান না হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ বাংলাদেশের তিন দিক থেকে ভারতের অবস্থান।
এই ব্যাখ্যা হজম করতে অনেকেরই হয়তো সমস্যা হবে। অনেকেই আবার ভারতের কারণেই বাংলাদেশে উগ্রবাদের প্রসার ঘটছে এমন একটি ন্যারাটিভের বাজনা বাজাবেন। এই ন্যারাটিভ ভারতবিরোধী গোষ্ঠীর কাছে ‘ফ্রেশ অক্সিজেন’। ভারতের দ্বারা বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে শোষিত হওয়ার গালগল্পের সঙ্গে উল্লেখিত ন্যারাটিভটি ভারতবিরোধী প্রচারণায় নতুন সংযোজন।
বাংলাদেশে সামাজিক স্তরের প্রায় সবক্ষেত্রেই রয়েছে ভারতবিরোধী উপাদান; রাজনীতি, ধর্ম, সাংস্কৃতিক এমনকি ক্রীড়াঙ্গনেও। বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রির অভিযোগ আমাদের প্রজন্ম জন্মের পর থেকেই শুনে আসছি। দেশ বিক্রির রাজনীতি আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছি। ভারত ভাগের পর থেকেই দেশ বিক্রির গালগল্প সমাজের নিরেট বাস্তবতা হিসেবেই দেখা দিয়েছে।
পাকিস্তানি দখলদারেরা উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ট্যাবলেট খাইয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীকে ভারতবিরোধী দর্শনে অনুপ্রাণিত করেছিল। পাকিস্তানি শাসকেরা সেই দর্শনের গোঁড়ায় ২৪টি বছর পানি দেয়। এমনকি ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সাল অবধি যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল, সেটির উদ্দেশ্যও ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম জনগণের ভেতরে ইসলামিক জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলা। এতে ভারতের বিরোধী রাজনীতি করাও হল, একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনাও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দ্বারা দমন করা হল।
স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য কেবল ক্ষমতার রাজনীতি নয়, তাতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার স্বাক্ষর স্পষ্ট।
উদ্বৃতি :“বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতি করলে ভোট পাওয়া যায়, ক্ষমতায় থাকা যায়।”
স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পরপরই ভারতবিরোধী রাজনীতি রাষ্ট্রীয় নীতিতে স্থান পায়। তখন দেশ বিক্রির অভিযোগ ছিল না, অভিযোগ ছিল ভারত দ্বারা বাংলাদেশ দখলের। জিয়াউর রহমানের পুরো সময়টিতে ভারত বাংলাদেশকে দখল করে নিয়ে যাবে– এমন একটি গানাবাজানা নিরাপদ দূরত্ব থেকে বাজানো হয়েছিল। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর মতোই তিনি ভারতের বিরুদ্ধে দেশের ভেতর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে সামনে আনার সব ধরনের চেষ্টা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের পর হুসাইন মুহম্মদ এরশাদও একই কাজ করেছেন। এরশাদ ভারতের কুচবিহার সফরের সময় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন:
“বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতি করলে ভোট পাওয়া যায়, ক্ষমতায় থাকা যায়।”
এরশাদ সত্যই বলেছিলেন। একানব্বই সালের নির্বাচনে ‘ভারতবিরোধী কার্ড’ বিএনপির ঘরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট এনে দেয়।
ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই। একানব্বই সালের নির্বাচনের সময় নেত্রকোনার দূর্গাপুরের সীমান্ত থেকে সন্ধ্যার পরে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে মাইকিং করাতেন। আর দিনে সাধারণ জনগণকে বিএনপির নেতাকর্মীরা বোঝাতেন, আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার জন্য ভারত সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। বিষয়টি দূর্গাপুরে সেই সময়ে কর্মরত সরকারি উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার কাছ থেকে শোনা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরেও দেশ বিক্রির জিগির তোলা হয়। রাজনৈতিক সমাজ ছাড়া দেশের সুশীল সমাজ ও ইসলামিক ধর্মীয় দলের মধ্যেও ভারতবিরোধী জিগিরের ধ্বনি পরিলক্ষিত হয়। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সরাসরি দেশ বিক্রির অভিযোগ তোলেন।
বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির বাস্তবতায় ভারতবিরোধী রাজনীতির বাইরে বিএনপির আর কোনো রাজনীতি অবশিষ্ট নেই। বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য মনমোহনের কংগ্রেস সরকার অনেক চেষ্টা করেছে। ভারত সফরের সময় তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা বেগম জিয়াকে সব ধরনের রীতিনীতি ভেঙে যে ধরনের সম্মান ভারত দিয়েছিল, সেটি দেশটির ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
যতদূর শোনা যায়, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তারেক রহমান লন্ডনে বিজেপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জামায়াত ও বিএনপির মধ্যকার সম্পর্কই নাকি বিজেপির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
বিএনপি বড় ধরনের একটি মিরাকেলের জন্য অপেক্ষা করছিল, এখন করছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলির নব্য ভূ-রাজনীতির মেরুকরণের উপরে বিএনপিকে আস্থা রাখতে হচ্ছে। চীন থেকে শেখ হাসিনা সরকারের সাবমেরিন ক্রয়, মিয়ানমারের কাছে ভারতের সাবমেরিনবিধ্বংসী টর্পেডো বিক্রয়, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগসহ তিস্তার পানির ন্যায্য অংশীদারিতে মমতার ‘না’সহ সবকিছুই বিএনপিকে আশান্বিত করে তুলেছিল। কিন্তু সব ছাপিয়ে যখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত বিরল সম্মান দেখাল, তখনই বিএনপির ভারতবিরোধী ‘টেপ রেকর্ডার’ আবারও বেজে উঠল।
বিএনপির সেই দেশ বিক্রির রূপকথা জন্মের পর থেকে শুনতে শুনতে নিজের বয়সও গড় আয়ুর অর্ধেক অতিক্রম করল। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদে ‘উলুধ্বনি’ শোনা যাবে কিংবা ফেনীসহ দেশের অর্ধেকটা ভারত নিয়ে যাবে জাতীয় ভারতবিদ্বেষী বক্তব্য আবারও খালেদা জিয়ার গলায় নতুন করে শুনতে পেলাম।
যারা ভূ-রাজনীতির সামান্যতম জ্ঞান রাখেন তারা অবশ্যই জানেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে বহু দেশ ভেঙে ছোট ছোট দেশে পরিণত হচ্ছে। এখন সেই বাস্তবতা নেই যে ইচ্ছে করলেই ভারতের মতো একটি দেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া পাশের একটি দেশকে ক্রয় করতে পারে।
তাছাড়া বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। উপমহাদেশের ইতিহাস সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস। যেখানে ভারত কাশ্মীরের মতো একটি রাজ্যের অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে ১৬ কোটি জনগণের দেশকে কীভাবে সামলাবে? ভারতের রাজনীতিবিদেরা কি আর বিএনপি-মার্কা রাজনীতি করেন যে তাঁরা দেশটির পশ্চিম ফ্রন্টের ন্যায় পূর্ব ফ্রন্টের সীমান্তকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলার মতো আত্নঘাতী হয়ে উঠবেন?
যাহোক, আপসকামী রাজনীতিবিদ, অপুষ্টিতে আক্রান্ত সুশীল সমাজ ও ধর্মীয় ফেরিওয়ালাদের দেশ বিক্রির অভিযোগটি একেবারেই মিথ্যা নয়। দেশ বিক্রি হচ্ছে, তবে ভারতের কাছে নয়, উগ্রবাদী শক্তির হাতে। সত্তর দশক-উত্তর যেসব মুসলিমপ্রধান দেশগুলি ধ্বংস হচ্ছে আমরা যদি সে দেশগুলির সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় নিই, বলা যায় যে আমরা ধীর লয়ে কিন্তু নিশ্চিতভাবে তাদের পথেই হাঁটছি। আমাদের রাজনীতিবিদদের এটি স্বীকার করে নেওয়াটা এখনই জরুরি।
বাংলাদেশের মতো কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশ ছাড়া প্রায় প্রতিটি মুসলিমপ্রধান দেশেই একটি সাধারণ চিত্র দেখা যায়। চিত্রটি হল, ধর্মান্ধতায় উন্মাদিত হয়ে নিজেদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের সামনে নব্য ধ্বংসাত্মক উপাদান ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া। নিজেদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সাংঘর্ষিক রূপ এখন এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশেই নতুন বাস্তবতা। এসব দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই, নেই কোনো মানবাধিকার। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় সন্ত্রাসের প্রধান শিকার হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে গোত্রভিত্তিক সংঘাত দেখা দিয়েছে। এসব মানব সভ্যতাবিরোধী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার মূলে রয়েছে ইসলামের নামে ‘সালাফিজম’ ও ‘ওহাবিজম’ ধারণা। এ দুটি ধারণা যে মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীতে প্রভাবশালী হয়ে আছে, সেই গোষ্ঠীগুলি আন্তঃসংঘাতের আগুনে দাও দাও করে জ্বলছে; সেই আগুন থেকে ইরাক, সিরিয়ায়, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, লিবিয়া ও মিসর মুক্তি পায়নি। কুয়েত ও সৌদি আরবও মুক্তি পাচ্ছে না। এসব দেশে মানুষের জীবনের চেয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা বড়, হাজার হাজার বছরের সভ্যতা ও ঐতিহ্য ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কাছে গৌণ। এখানে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। উদাহরণ হিসাবে নিয়ে আসতে পারেন কাতার, ব্রুনাই কিংবা আরব আমিরাতকে। সেখানেও উগ্রবাদের ভয়ানক থাবা রয়েছে। ব্রুনাইয়ে প্রকাশ্য বড়দিন পালন করা নিষেধ, করলে পাঁচ বছরের জেল হতে পারে। বলা যায় প্রায় অধিকাংশ মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে ধর্মীয় অনুশাসনের প্যারামিটারগুলি কট্টরবাদীদের ধারণার সমান্তরালে চলতে হচ্ছে। সেসব দেশের সমাজও ক্রমশ কট্টরবাদে সহিষ্ণু হয়ে উঠছে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে আরও সহজ হবে। যেমন ধরুন, ব্লাসফেমি আইন। মুসলিম প্রধান দেশগুলিতে এই আইনের সিংহভাগ শিকার হন নন-মুসলিমরা। পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তদের ৯০ ভাগের উপরে নন-মুসলিম। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল গজরা থেকে স্থানীয় ইমাম মোহাম্মদ ইমামের কথিত অভিযোগে একটি প্রতিবন্ধী খ্রিস্টান দম্পতিকে ব্লাসফেমি আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। এই পঙ্গু দম্পতিকে পুলিশ প্রকাশ্যে নির্যাতন করে ব্লাসফেমির অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয়। ২০১৬ সালে এই পঙ্গু দম্পতিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
সময়ের পরিক্রমায় ব্লাসফেমি আইনের চর্চাকারী সমাজগুলিতে কট্টরপন্থার প্রয়োগ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এখন কাউকে মেরে ফেলতে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে ব্লাসফেমির অভিযোগের দরকার হয় না, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের চিন্তার বাইরে অবস্থান নিলেই হল। এই মাসের ১৩ তারিখে পাকিস্তানের একটি ঘটনা। ব্লাসফেমির গুজব ছড়িয়ে আবদুল ওয়ালি খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মার্শাল খানকে হত্যা করা হয়। অনেকেই বলছেন তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আবার অনেকেই বলছেন তাঁকে তক্তা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এখন জানা যাচ্ছে যে মার্শাল খান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করার কারণেই তাঁকে ব্লাসফেমির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের চিন্তার বাইরে থাকাই এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। উদাহরণ হিসেবে সৌদি আরবের শিয়া ধর্মীয় গুরু নিমর-আল-নিমরের কল্লা কাটার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারি। নিমরের অপরাধ ছিল সে সৌদি প্রশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, সংখ্যালঘু শিয়াদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। তাঁকে সন্ত্রাসের মদদদাতা বানিয়ে সৌদির স্থানীয় আইনে হত্যা করা হয়। তাই বলছি এখন আর ব্লাসফেমি আইনে সাজাপ্রাপ্তদের রায় কার্যকর করার জন্য কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয় না। অনেকে দেশে অভিযোগটিই মুখ্য, বিচারের নামে ‘নাটক’ করার প্রয়োজনীয়তা তেমন নেই।
উগ্রবাদ প্রাথমিকভাবে শুরু হয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষ ও ধর্মীয় সন্ত্রাস করে; পরে এটি ধর্মীয় গোত্রতে ছড়িয়ে পরে। আস্তে আস্তে উগ্রবাদ ‘চরমবাদে’ রূপ নয়, চরমবাদ জঙ্গিবাদে। ফলে জঙ্গিবাদ সমাজের বিচ্ছিন্ন ঘটনা– এমন ধারণা একেবারেই ভুল। যখন কোনো সমাজ জঙ্গিবাদে আক্রান্ত হয়, তখন বুঝতে হবে যে জঙ্গিবাদের মৌলিক উপাদান সমাজে ভেতরেই রয়েছে; সেসব উপাদানের শেষ স্তর হচ্ছে জঙ্গিবাদ। উগ্রবাদ থেকে চরমবাদ ও চরমবাদ থেকে জঙ্গিবাদ একটি চক্রাকার পদ্ধতি অনুসরণ করে। এটি একটি একমুখী রাস্তা। এই রাস্তায় যে জনগোষ্ঠী একবার যাত্রী হয় সেই জনগোষ্ঠীর দ্বারা চক্রাকার রাস্তা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। গত কয়েক দশক ধরে যে কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশ এই চক্রাকার রাস্তার পথিক হয়েছে, তাদের সামাজিক অবস্থানটি বিবেচনায় নিলেই বিষয়টি বুঝতে সহজ হয়। যে তিনটি মুসলিমপ্রধান দেশ এখনও নিজেদের ভূখণ্ড থেকে নানা উছিলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দিয়ে শূন্যের কোটায় নিয়ে আসেনি কিংবা তাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্র বিনির্মাণ করেনি, বাংলাদেশ তাদেরও একটি। বাকি দুটি ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া।
তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, যে মূলনীতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির জন্ম হল সেই মূলনীতি থেকে দেশ এখনও যোজন যোজন দূরে। ইচ্ছা করলেই সেখানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এজন্যই আওয়ামী লীগ এখন মাঠের বাস্তবতা সাপেক্ষে রাজনীতি করছে হচ্ছে বলতে বাধ্য হচ্ছে।
রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সংবিধান, রাষ্ট্রের চিন্তক গোষ্ঠী এবং ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিবিদেরা ত্বরিত ফলের জন্য উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে ও লালনপালন করে আজকের অবস্থায় নিয়ে আসছে। দেশের প্রগতিশীলতার মূল প্রদীপ আওয়ামী লীগ; সেটির সলতেও আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগকে যারা কেবল দার্শনিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য দশকের পর দশক সমর্থন দিয়ে আসছিল, তাদের ক্ষুধামন্দা লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
আপনি যদি পাবলিক ডোমেইনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সব চিন্তাচেতনা, আদর্শ ও দর্শনভিত্তিক বক্তব্য, কথাবার্তা ও প্রতিক্রিয়া নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করেন, দেখবেন তাদের একটি বড় অংশের মনন ডানপন্থায় নিমজ্জিত। এই প্যারামিটারটি রাজনৈতিক ‘রিজার্ভ ফোর্স’ হেফাজতে ইসলামের চেয়ে ভয়ংকর। আওয়ামী লীগের ভেতরে এখন দুটি শিবিরের অস্তিত্ব স্পষ্ট। একটি সাম্প্রদায়িক শিবির ও আরেকটি অসাম্প্রদায়িক শিবির। আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ এখন হেফাজতে ইসলামের ভাষায় কথা বলে, হেফাজতে ইসলামের সুরে সুর মেলায়।
আওয়ামী লীগ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে যে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের যা ঘটছে সেটি কেবল কৌশলগত। দেশে হেফাজতে ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত ভোটের সংখ্যা নাকি এক কোটি! সেই এক কোটি ভোট ব্যাংকের প্রতি আওয়ামী লীগের দৃষ্টি। হেফাজতে ইসলামের মধ্যযুগীয় ইচ্ছাকে যতই আওয়ামী লীগ তৃপ্ত করুক, হেফাজতে ইসলামের কোনো ভোটই আওয়ামী লীগ পাবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার পরপরই হেফাজতের নেতারা গণমাধ্যমে বলতে শুরু করেছে:
“নবী রাসুলকে (সা.) মানলে নারী নেতৃত্বকে মানা যায় না।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের অনেক অনুসারী বলাবলি করছেন, হয় সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে গ্রিক দেবীকে সরাতে হবে; আর সেটি না সরালে ক্ষমতা থেকে মূল দেবীকেই সরতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জিজ্ঞাসা, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে যে ভাস্কর্যটি ছিল সেটি কি কোনো দেবীর ছিল? হেফাজতিরা কিন্তু লালন ফকিরকেও মেনে নেয়নি। হেফাজতে ইসলামের ভাইরাস কীভাবে আওয়ামী লীগকে বিষে নীল করছে তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ শামিম ওসমানের বক্তব্য। সাংসদ শামিম ওসমান দাবি করলেন:
“৫ মের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হেফাজতে ইসলাম করেনি।”
হেফাজতে ইসলাম যদি না-ই করে থাকবে, কেন সরকার বাবু নাগরীকে নয় দিনের রিমান্ড নিয়েছিল? কেন হেফাজতে ইসলামের বহু নেতাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছিল? কেন রাফিউল রাব্বির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি কায়দায় মিথ্যা ধর্মদ্রোহের অভিযোগ এনে হেফাজতে ইসলামকে দিয়ে মামলা করতে হবে?
আওয়ামী লীগের মতো দলে যখন হেফাজতিকরণের হাওয়া লাগে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে দেশের খরিদ্দার ভারত নয়, খরিদ্দার দেশের উগ্রবাদী গোষ্ঠীরা।
Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত