প্রবাসে দেশীয় রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা



ভ্লাদিমির লেনিন, আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং ইয়াসির আরাফাত। তিনজন ভিন্ন ভিন্ন সময়ের তিন পুরুষ। ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী তিন রাজনীতিক। তবে একটি বিষয়ে তাদের অদ্ভুত মিল। রাজনৈতিক কারণে তারা প্রত্যেকে প্রবাসে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। লেনিন ফিনল্যান্ড, জার্মানিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। খোমেনি ফ্রান্সে এবং আরাফাত লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। নিজ দেশে নিষিদ্ধ ছিল তাদের মতাদর্শের রাজনীতি। ফলে আশ্রয় নিয়েছেন প্রবাসে। সেখানে বসে সাংগঠনিক তৎপরতাসহ চালিয়েছেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। যথোচিত সময়ে আবার ফিরে গেছেন নিজ নিজ দেশে এবং দেশ পরিচালনা করেছেন সক্রিয়ভাবে।

লেখক উক্তি:এক কথায়, বাংলাদেশিদের অবস্থা লেনিন, খোমেনি বা আরাফাতের মতো নয়। তাহলে তো স্বদেশই হবার কথা তাদের দেশীয় দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্র!

প্রচলিত অর্থে ‘রাজনীতি’ (contextual) যা রাষ্ট্রের অবস্থান, রাষ্ট্রীয় সীমানা এবং রাষ্ট্রীয় কর্মতৎপরতা প্রয়োগের পরিধি দ্বারা বেষ্টিত। Context এর বাইরে এলেই রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। প্রচলিত সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত ‘রাজনীতি’র উদ্দেশ্য নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আহরণ এবং জনগণের সেবা প্রদান। প্রবাসে বাংলাদেশি রাজনীতির রাষ্ট্রও নেই, নির্বাচনও নেই। আর ক্ষমতায় আরোহণের চিন্তা নির্ঘাত বোকামি। ভাবাও অবান্তর এবং অবাস্তব। তারপরও কেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে এত যোগাযোগ?

উত্তর কোরিয়া বা চীনের মতো বাংলাদেশে ভিন্ন মতাদর্শভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়। মিয়ানমার বা জিম্বাবুয়ের মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সীমাবদ্ধতাও নেই সেখানে। বরঞ্চ, স্বইচ্ছায় অভিবাসনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বাঙালি বসবাস করছেন ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বহু দেশে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিবাসীরা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আর কোনোদিনই হয়তো ফিরবেন না বাংলাদেশে।

যারা প্রবাসে দেশীয় দলীয় রাজনীতির বিরোধী, তাদের দুটি মন্তব্যের দ্বিতীয়টির সঙ্গে আমি একমত। রাজনীতিতে আগ্রহীরা ধীরে ধীরে প্রবাসের মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের জড়াতে পারেন। রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে তাদের উর্ধগমন উজ্জ্বল করবে কমিউনিটির মুখ। এ বিষয়ে বিলেতপ্রবাসী বাঙালিরা কিছুটা এগিয়ে। তবে তাদের লেগেছে দীর্ঘদিন। অন্যান্য প্রবাসে এ প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ঘটুক সেটাই কাম্য।’

এক কথায়, বাংলাদেশিদের অবস্থা লেনিন, খোমেনি বা আরাফাতের মতো নয়। তাহলে তো স্বদেশই হবার কথা তাদের দেশীয় দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্র!

যুক্তিযুক্ত কথা। এ যুক্তি আরও দৃঢ় হয় যখন দেখি না কোনো অস্ট্রেলিয়ানকে বাংলাদেশে লেবার-লিবারেল-ন্যাশনালের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে। অথবা বিলেতিদের অস্ট্রেলিয়ায় লেবার-কনজারভেটিভ-সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টি খুলে বসতে। এমনকি ভারতীয়দের মাঝে কংগ্রেস বা বিজেপির শাখা-প্রশাখার কথা শোনা যায় না সচরাচর। তবে কেন প্রবাসে বাঙালিদের দেশি রাজনীতি?

পাশাপাশি এটাও সত্য, অনেকে এ ধারার বিরোধী। তাদের মতে, প্রথমত, প্রবাসে বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির চর্চা অর্থহীন; দ্বিতীয়ত, রাজনীতিতে আগ্রহীরা প্রবাসের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন। মন্তব্য দুটি আমাদের অনেককেই ভাবায়।

যারা প্রবাসে দেশীয় দলীয় রাজনীতির বিরোধী, তাদের দুটি মন্তব্যের দ্বিতীয়টির সঙ্গে আমি একমত। রাজনীতিতে আগ্রহীরা ধীরে ধীরে প্রবাসের মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের জড়াতে পারেন। রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে তাদের উর্ধগমন উজ্জ্বল করবে কমিউনিটির মুখ। এ বিষয়ে বিলেতপ্রবাসী বাঙালিরা কিছুটা এগিয়ে। তবে তাদের লেগেছে দীর্ঘদিন। অন্যান্য প্রবাসে এ প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ঘটুক সেটাই কাম্য।

দ্বিতীয় মন্তব্যের সঙ্গে একমত হলেও, প্রথম মন্তব্যের সঙ্গে নই। তবে কি বাংলাদেশিদের জন্য প্রবাসে রাজনীতির সংজ্ঞা খুঁজতে হবে রাজনীতির প্রচলিত সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে? তবেই কি রাজনীতি কনটেক্সচুয়ালের আবরণ থেকে বেরিয়ে আসবে?

প্রশ্নটি একটু ভিন্নভাবে করলে কেমন দাঁড়ায় দেখি। বাংলাদেশের কোন্‌ ধরনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশি রাজনীতি প্রবাসে প্রাসঙ্গিক হবে? তবে কি দেশে সেই ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে, প্রবাসে দেশি রাজনীতি প্রাসঙ্গিকতা হারাবে? কেমন সে রাজনৈতিক পরিবেশ?

বিষয়টি অনুধাবনের তাগিদে সাধারণ মানুষের কয়েকটি সহজাত বৈশিষ্ট্যের উপলব্ধি অত্যাবশ্যক।যেমন, মানুষ মানুষকে মানুষ হিসেবেই গ্রহণ করে, যতক্ষণ না উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী কোনো গোষ্ঠী অন্যভাবে প্রভাবিত করে। আর মানুষ মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার সহজ মানে হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। এটা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যের অন্যতম।

মানুষ সম্মান প্রত্যাশা করে একে অপরের কাছে। এটাও মানুষের সহজাত। সামাজিক অবস্থানের বিন্যাসে যার যতটুকু প্রাপ্য, প্রত্যেকের ততটুকুই প্রত্যাশা। কোনো বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কাউকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠতম পন্থা। এটা মানবাধিকারও বটে। আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এ সুযোগ দেওয়ার সহজ অর্থ, গণতন্ত্র।

মানুষের কর্মস্থল কিংবা বসবাস পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, সে খোঁজে তার শিকড়। এটা মানুষের আরও একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। সে কে? জানতে চায় নিজেকে। কী তার অতীত, বর্তমান? কী তার সত্তা? আর এই মানুষে মানুষে মিলে হয় সমাজ। সেখানে ভাষায় ঘটে আদান-প্রদান। গড়ে ওঠে সম্পর্ক। সম্পর্ক ঘিরে শুরু হয় বসবাস। আর বসবাসের পরিবেশ-পারিপার্শিকতা, যেমন জল, মাটি, বায়ু– এক কথায়, জলবায়ুর ছোঁয়ায় রূপ নেয় গায়ের রঙ, দেহের গড়ন, আহার-নিদ্রার অভ্যাস এবং পোশাক-আশাকের ধাঁচ। এ সবের প্রভাবে জন্ম নেয় আত্নপ্রকাশের ধরন। যেমন, নৃত্যের তাল ও ভঙ্গিমা, সঙ্গীতের সুর। আর এ সব মিলেই হয় সংস্কৃতি। যার নিত্যদিনের প্রকাশ আর অভিজ্ঞতার আলোকে জন্ম নেয় একটি জাতীয় সত্তা। যেমন, বাঙালি জাতি। জাতিসত্তার এ উপাদান জাতির ইতিহাসের ধারাবাহিকতারই স্বরূপ।

তাহলে, মানুষ মূলত মানুষে-– মানে ধর্মনিরপেক্ষতায়; মানুষের সম্মানে-– মানে গণতন্ত্রে; মানুষের নিজ সত্তায়-– মানে বাঙালিত্বে এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী। আর এই সব মূল্যবোধে এবং মূলধারা একাত্তরের স্পিরিটে জন্ম হয়েছে বাঙালি জাতির দিকনির্দেশনা। যদি কখনও বাঙালির এসব সহজাত বিশ্বাস এবং বৈশিষ্ট্যে আঘাত আসে? যদি তা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়? তবে কি এ সবের প্রতিবাদ-প্রতিকারের রাজনীতি প্রবাসে প্রাসঙ্গিক হবে?

বিষয়টি অনুধাবনের সুবিধার্থে এখানে কয়েকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করছি।

• যখন বাংলাদেশের ইতিহাস-বিকৃতি হয়, তখন প্রবাসে এক শ্রেণি তাতে সমর্থন জোগায়। অন্য এক শ্রেণি মনে করে এ নিয়ে সময় ব্যয় নিরর্থক। তাদের মতে, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর এ বিষয় তাৎপর্যহীন। তখন নীতিগত কারণে তৃতীয় কোনো এক শ্রেণিকে স্ট্যান্ড নিতেই হয়।

• যখন স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়, তখন এক শ্রেণি তার বিরোধিতা করে, প্রবাসে প্রকাশ্যে মিটিং-মিছিল করে। সেই সঙ্গে প্রবাসের কংগ্রেস কিংবা পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে বিচার বন্ধের জন্য লবিং করে। অন্য এক শ্রেণি বিচার-প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, ভ্রান্ত এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয় বলে ধুয়া তুলে বিচারকে কন্ট্রোভার্শিয়াল করার প্রচেষ্টা চালায়। তখন আবার এগিয়ে আসে তৃতীয় এক শ্রেণি, একই নীতিগত কারণে।

• যখন প্রবাসে মসজিতে মসজিতে জুম্মার নামাজের পর লিফলেট বিলি করে এই বলে যে, বাংলাদেশে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চলছে– অন্য এক শ্রেণির এ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই– মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে তখন তৃতীয় শ্রেণিটিকে দাঁড়াতে হয়।

• ২০০১এর নির্বাচনের পর বাংলাদেশে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পরও প্রবাসে এক শ্রেণির বাংলাদেশি যখন বলে, তেমন কিছুই ঘটেনি, সেখানে অন্য এক শ্রেণি তখন নিশ্চুপ। সেই সময় তৃতীয় কোনো এক শ্রেণির এ বিষয়ে এগুতে হয়।

• প্রবাসে এক শ্রেণি যখন ‘জাতীয় শোক দিবসে’ জন্মদিন পালনের আনন্দে মেতে উঠে– অন্য এক শ্রেণি যখন সিদ্ধান্তে ‘সমদূরত্ব’ বজায় রাখে– তখন নীতিগত কারণে তৃতীয় কোনো এক শ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হয়।

আর এসব কারণেই প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায় প্রবাসে দেশি রাজনীতির বিষয়টি। তবে সেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরণ-ধারণ কেমন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু কারা এই তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত বাঙালি?

বাংলাদেশের সুধীজন প্রায়ই বলে থাকেন, ‘নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারলে, সারা বাংলাদেশ হারে’– তাহলে কি বাঙালির সহজাত বৈশিষ্ট্য আর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মূল্যবোধ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত? বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬, এই ২৬ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। কী দেখেছি তখন? শুরুতেই দেখি সামরিকতন্ত্র, যা চলে একাধিক পর্বে। দেখি, ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের উত্থান। স্বাধীনতাবিরোধী এবং স্বাধীনতার মূল্যবোধে অবিশ্বাসীদের ক্ষমতায় আরোহণ। ধর্মনিরপেক্ষতার উপর সরাসরি আঘাত। স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাঙালি জাতিসত্তার বিকৃতি। এক কথায়, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬এর ইতিহাস বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যের অবক্ষয়ের ইতিহাস।

ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতিসত্তা, সঠিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এবং স্বাধীনতার স্পিরিট– এগুলোই হচ্ছে বাঙালি জাতির দিকনির্দেশনার ভিত্তি। অস্ট্রেলিয়া, ভারত বা বিলাতের, এমনকি পাকিস্তানের জাতীয় দিকনির্দেশনায় কখনও আঘাত আসেনি। তাই তাদের দেশি রাজনীতি প্রবাসে প্রাসঙ্গিক নয়। যতদিন বাংলাদেশের মানুষের সহজাত মূল্যবোধ এবং সঠিক ইতিহাসের ভিত্তিতে জাতীয় দিকনির্দেশনা পুনরুজ্জীবিত এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন এই ধারার দেশি রাজনীতি প্রবাসে প্রাসঙ্গিক থাকবে। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা হারাবে, তার আগে নয়।

Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত



Shams

লেখক পরিচিতি

শামস রহমান
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক