লেখক পরিচিতি
ড. আনিসুজ্জামান
বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক। ওনাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই।।
বাংলাদেশের গোড়াপত্তন যে-ভাষা আন্দোলনে, তার গোড়ায় ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। যে-রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, তার সূচনায় তাঁর আত্মাহুতি। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নামটি তাই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাঁকে আমরা ভুলিনি। তাঁর কথা বলতে গেলে পুনরাবৃত্তিরই সম্ভাবনা। তাতে ক্ষতি নেই, বরঞ্চ তাই প্রয়োজন আজ। তিনি পূণ্যশ্লোক, তাঁর নাম বারবার উচ্চারণ করি। তিনি মহাপ্রাণ, তাঁকে অনুসরণের জন্য সকলকে আহ্বান করি। তিনি সত্যনিষ্ঠ, সেই সত্যের কণ্টকময় পথে অবিরাম না চলতে পারলে আমরা কখনও গন্তব্যে পৌঁছুতে পারব না।
লেখক উদ্বৃতি : ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিজে যা করেছিলেন, তার চেয়েও তাঁর বড় কীর্তি আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দেওয়ায়। সে আগুন সবখানে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
সবাই জানেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ছমাসের মাথায়, ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, গণপরিষদে একটি ছোট সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। ধীরেন্দ্রনাথের সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, সেই সঙ্গে বাংলাও পরিষদের সরকারি ভাষারূপে গণ্য হবে।
ধীরেন্দ্রনাথ সংশোধনীটি দাখিল করেন ২৩ ফেব্রুয়ারিতে আর তা গণপরিষদে আলোচিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারিতে। ‘আজাদ’ পত্রিকায় ৪ মার্চে প্রকাশিত হাবীবুল্লাহ বাহারের বিবৃতি থেকে জানা যায় যে, গণপরিষদের আলোচনার আগে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের সভায় বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল এবং তিনি ও মুসলিম লীগ দলীয় আরও কোনো কোনো সদস্য– তাদের মধ্যে উর্দুভাষী সদস্যও ছিলেন– তা সমর্থন করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভোটে তাঁরা হেরে যান এবং সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয় ওই সংশোধনীর পক্ষে কিছু না বলার জন্যে।
তারপরও তিনি এবং আরও দুজন সদস্য কিছু বলতে চেয়েছিলেন, অবশ্য বললে হয়তো তাঁরা বাংলা ভাষার প্রতি সরকারি অবিচারের কথা বলতেন কিংবা বাংলা ভাষার প্রতি এদেশের মানুষের গভীর ভালোবাসার কথা বলতেন, সংশোধনীর পক্ষে কিছু বলতে পারতেন না– তবে তাদের বলতে দেওয়া হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, পরের দিনের ‘আজাদ’এ এ নিয়ে বাহারের প্রতি কটূক্তি করা হয়েছিল এবং জিন্নাহর– তিনি ছিলেন গণপরিষদের সভাপতি– প্রতি দোষারোপ করার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁকে।
এ তো হল যা হয়নি। এবারে দেখা যাক কী হয়েছিল। প্রস্তাব উত্থাপন করতে গিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আরও কিছু বলেছিলেন। প্রথমে বলেছিলেন, সরকারি কাগজপত্রে মুদ্রায়, নোটে, মনিঅর্ডার ফরমে, ডাকটিকিটে– বাংলা ভাষা অবহেলিত, তাতে জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে। তারপর বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষারূপে রাষ্ট্রভাষার সম্মান বাংলার প্রাপ্য।
পরিষদের নেতা লিয়াকত আলী খান বলেন, তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন যে, সংশোধনীটা নির্দোষ। তা যদি হয় তবে তারা তা গ্রহণ করলেন না কেন? কারণ, তার মতে, ধীরেন্দ্রনাথের বক্তৃতার পরে তাঁর মনে হয়েছে যে, পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি এবং ভাষাগত ঐক্য স্থাপনে বাধাদান এর উদ্দেশ্য। তিনি আরও বলেন, পাস্তিান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, এর রাষ্ট্রভাষা হবে এদেশের মুসলমানদের ভাষা– উর্দু।
আজাদ’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে বলা হয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা: (ক) পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই তার রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাদানুবাদ হয়েছিল; (খ) দেশের ৬১ শতাংশ মানুষের ভাষা বাংলা পাকিস্তানে উপেক্ষিত হতে পারে না, বরঞ্চ তা রাষ্ট্রভাষা হবার যোগ্যতা রাখে; (গ) ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব সম্পূর্ণ যৌক্তিক; (ঘ) প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানকে মুসলিম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করলেও কায়েদে আজম বহুবার দেশকে বলে ঘোষণা করেছেন, সুতরাং লিয়াকতের বক্তব্যে গুরুত্ব আরোপ করা যায় না; (ঙ) তবে তিনি যে উর্দুকে মুসলমানের জাতীয় ভাষা বলে অভিহিত করেছেন, এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই; (চ) গণপরিষদের সিদ্ধান্তে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে নিষ্ঠুর আঘাত দেওয়া হয়েছে, ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষায় পূর্ব বাংলা আজ বিক্ষুদ্ধ।
তার সুরে অনেকেই সুর মেলালেন। খাজা নাজিমুদ্দিন বললেন, পূর্ব বাংলায় শিক্ষা ও সরকারি কাজের বাহন হবে বাংলা– এ সম্পর্কে সেখানকার মানুষের আবেগ প্রবল– তবে উর্দু পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা হলে তারা আপত্তি করবে না।
কংগ্রেস দলের সদস্যরা সংশোধনীর পক্ষে দুটি কথা বললেন। সংশোধনী প্রস্তাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়া হয়নি, গণপরিষদের ভাষা করতে চাওয়া হয়েছে মাত্র। দ্বিতীয়ত, পরিষদের নেতার বক্তৃতা থেকে মনে হয়েছে যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুসলমান-অমুসলমানের অধিকার সমান নয়। এ কথা অমুসলমানদের বিশেষ করে ভেবে দেখতে হবে।
তমিজউদ্দীন খান স্মরণ করিয়ে দেন যে, গণপরিষদের সভাপতি সব সময় বলেছেন, পাকিস্তানে সকল নাগরিকদের অধিকার সমান। তবে তমিজউদ্দীনও সংশোধনীর বিরোধিতা করেন।
ভোটে প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য হয়। এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা ধর্মঘট করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানানো হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি সারা প্রদেশে ছাত্র-ধর্মঘট ও প্রতিবাদ-সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিনই ‘আজাদ’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে বলা হয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা:
(ক) পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই তার রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাদানুবাদ হয়েছিল; (খ) দেশের ৬১ শতাংশ মানুষের ভাষা বাংলা পাকিস্তানে উপেক্ষিত হতে পারে না, বরঞ্চ তা রাষ্ট্রভাষা হবার যোগ্যতা রাখে; (গ) ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব সম্পূর্ণ যৌক্তিক; (ঘ) প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানকে মুসলিম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করলেও কায়েদে আজম বহুবার দেশকে বলে ঘোষণা করেছেন, সুতরাং লিয়াকতের বক্তব্যে গুরুত্ব আরোপ করা যায় না; (ঙ) তবে তিনি যে উর্দুকে মুসলমানের জাতীয় ভাষা বলে অভিহিত করেছেন, এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই; (চ) গণপরিষদের সিদ্ধান্তে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে নিষ্ঠুর আঘাত দেওয়া হয়েছে, ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষায় পূর্ব বাংলা আজ বিক্ষুদ্ধ।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব কী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, তা বোঝাতেই এত কথার অবতারণা। ১১ মার্চে সমগ্র প্রদেশে ধর্মঘটও হয় এই সূত্রে, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পালা চলে এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ১৫ মার্চ নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৮ এপ্রিলে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে পূর্ব বাংলায় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ এবং যথাসম্ভব শীঘ্র বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন খাজা নাজিমুদ্দীন।
আবারও সংশোধনী আনেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাতে গণপরিসদের সদস্যদের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের অনুরোধ করা হয় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। কিন্তু সে-প্রস্তাবও পাস হয়নি।
পাস হয়নি বললে ভুল হবে। পাস হয়েছিল, তবে ১৯৪৮এ নয়, ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন প্রস্তাব উত্থাপন করেন, পাকিস্তান গণপরিষদের কাছে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ সুপারিশ করছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা করা হোক। তবে এই প্রস্তাব উত্থাপন ও পাস করার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তদানের। সেদিনও গুলি চালনার পর ব্যবস্থাপক পরিষদের প্রথমে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও তারপরেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন যে, গুলিতে ছাত্রহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষদের কাজে অংশগ্রহণ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলের মূলতবি প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলে তাঁরা পরিষদ ছেড়ে চলে যান।
পরদিন পরিষদ আবার বসলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিবাদ করেন ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার মিথ্যাচারের। জানতে চান কারফিউ জারি করা হয়েছে কিনা, শহরের নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর ওপরে অর্পিত হয়েছে কিনা। তিনি নূরুল আমিনের কোনো কোনো উক্তির প্রতিবাদ করেন এবং গণপরিষদের পূর্ববঙ্গীয় সদস্যদের প্রতি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব তোলার বিষয়ে ম্যানডেট দেওয়ার জন্যে মনোরঞ্জন ধরের প্রস্তাব সমর্থন করেন।
১৯৫২ সালের এপ্রিলে গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি উত্থাপন করেন মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য নূর আহমদ। লীগ দলেরই পশ্চিম পাকিস্তানি একজন সদস্য প্রস্তাবটি মূলতবি রাখার উদ্দেশ্যে সংশোধনী আনেন সেটিই গৃহীত হয়। কিন্তু সেদিনও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল বাংলার দাবির সমর্থনে এবং মুসলীম লীগ দলীয় সদস্যদের নিন্দায়।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিজে যা করেছিলেন, তার চেয়েও তাঁর বড় কীর্তি আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দেওয়ায়। সে আগুন সবখানে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত