জিঞ্জিরা গণহত্যা দিবস


৪৭ বছর আগে ২ এপ্রিল ১৯৭১ কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিঞ্জিরা,কালিন্দি ও শুভাড্যা এই তিন ইউনিয়নব্যপী সংঘটিত হয়েছিল হৃদয় বিদারক গণহত্যা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক, বর্ণনার অতীত নৃশংস ভয়াবহতা এদিন প্রত্যক্ষ করেছিলেন কেরানীগঞ্জবাসী।

ঢাকা শহরের দক্ষিন প্রান্তে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পারে অতি নিকটবর্তী হওয়ার কারণে, একাত্তরে কেরানীগঞ্জ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। একটি বিষয় অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে, একাত্তরে সালে কেরানীগঞ্জের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা, তখন পর্যন্ত কোন সেতু স্থাপিত হয়নি।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালরাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে জাতীয় পর্যায়ের সকল নেতবৃন্দ কেরানীগঞ্জে এসে অবস্থান নেন। কেরানীগঞ্জে বসেই জাতীয় নেতৃবৃন্দ পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা তৈরী করেন। উল্লেখ্য, ২৬ শে মার্চ প্রত্যুষে কেরাণীগঞ্জের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা উড়েছিল। তৎকালীন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা মোস্তাফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বে কেরানীগঞ্জ থানা দখল করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

২ এপ্রিল ১৯৭১, সেদিন শুক্রবার। অপারেশন সার্চলাইটের (২৫ মার্চ রাতে) নৃশংসতম গণহত্যা সূচিত হবার পর ঢাকা শহরের বেঁচে যাওয়া মানুষ প্রথম নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত জিঞ্জিরার দিকে যাত্রা করে।

ছবি:কেরানীগঞ্জে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নিহত তাঁতি। Photo Credit:Late Rashid Talukdar

জিঞ্জিরা ও এর আশেপাশের এলাকাগুলো তখন প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ছিল। Ethnic Cleansing বা জাতিসত্ত্বা নির্মূলের পরিকল্পনা আগে থেকেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরিকল্পনার অংশ ছিল। যখন ঢাকা থেকে প্রাণ রক্ষার্থে সবাই সেখানে জড়ো হতে থাকেন, তখনই পাকিস্তানী মিলিটারি সেখানে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নেয়। ১ এপ্রিল মধ্যরাতের পর থেকে অর্থাৎ ২ এপ্রিল ভোর থেকে জিঞ্জিরায় সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে এবং কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে।

পাকিস্তানী হার্মাদ বাহিনী সেদিন গভীর রাতেই ঢাকা শহরের দক্ষিন প্রান্তে বুড়িগঙ্গা নদীর এই পাড়ের মিটফোর্ড হাসপাতাল দখল করে নেয় এবং হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদের ছাদ থেকে আনুমানিক ৫ টি ফ্লেয়ার ছুড়ে গণহত্যা শুরু করার জন্য সংকেত প্রদান করে। আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫ টা থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে একটানা নয় ঘণ্টা নারকীয় তাণ্ডব অব্যহত রাখে এবং আনুমানিক সময় দুপুর আড়াইটা নাগাদ হত্যাযজ্ঞ শেষ করে।

এদিন কেরানীগঞ্জের ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা পরিচালিত করেছিল পাকিস্তানী সামরিক সদস্যরা। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেরানীগঞ্জ এক রক্তাক্ত জনপদে রূপ নেয়। মেশিন গান, মর্টারের গোলায় গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়। লুটিয়ে পড়ে কেরানীগঞ্জের হাজার হাজার নারী-পুরুষসহ ঢাকা থেকে প্রাণভয়ে ছুটে সাধারণ মানুষ। সেদিন আনুমানিক ৫ হাজার (মতান্তরে ৭ থেকে ১০ হাজার) নারী, পুরুষ, শিশু শহীদ মানুষকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে, একই কবরে ১০-১২টি করে লাশ দাফন করা হয়েছিল। নজরগঞ্জে একটি কবরে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নিতে আসা নাম না জানা ৫৪ জনকে দাফন করা হয়েছিল।

ছবি:রহমান মঞ্জিল,পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর টর্চার সেল-১৯৭১। Photo Credit:Jahir Ahmed Asif

এসময় তারা ঘরবাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে ষাট জন কে একসাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। সেদিনের নির্মম হত্যাকাণ্ডে জিঞ্জিরা, মনু বেপারীর ঢাল, নজরগঞ্জ, গোলজারবাগ, মান্দাইল, কুশিয়ারবাগ, বড়িশুর, মাদারীপুর এলাকা লাশের স্তুপে পরিণত হয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর একাধিকবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও ২ এপ্রিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে কেরানীগঞ্জের শহীদদের তালিকা করেনি কোন সরকার বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

"তৎকালীন পিটিভি (পাকিস্তান টেলিভিশন) একইদিন ২ এপ্রিল রাতে খবর প্রচার করেছিল," বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুস্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে।’

ছবি:রহমান মঞ্জিল,তৎকালীন সময়ে এ বাড়িটিই এলাকার একমাত্র পাকা বাড়ি ছিল।

জিঞ্জিরা গণহত্যার পরের দিন, অর্থাৎ ৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানী প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরা গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং দেশের মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য হত্যার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এরকম,"Action against miscreants at Jinjira" অর্থাৎ "জিঞ্জিরায় দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন"।

আর তৎকালীন পিটিভি (পাকিস্তান টেলিভিশন) একইদিন ২ এপ্রিল রাতে খবর প্রচার করেছিল," বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুস্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে"। আমরা এই নৃশংস গণহত্যার বিচার চাই। সেদিনের সকল শহীদের পূর্ণ তালিকা দাবী করি, আরও দাবী করছি সর্বস্বান্ত ও আপনজন হারানো সকলের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন। ৪৭ বছরে যা হয়নি, সেই নির্লজ্জ অপূর্ণতা ও ব্যর্থতা দূর করতে রাষ্ট্র যেন এবার এগিয়ে আসে।

Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত



Rahaman-Raad

লেখক পরিচিতি

গেরিলা ১৯৭১