লেখক পরিচিতি
তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও জননেতা ।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ যারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা তাদের আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
ঐতিহাসিক ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দল।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ভাষা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল এবং বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিল। যদিও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই ’৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে প্রাণপ্রিয় ছাত্রপ্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।একই বছরের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ’৫৩ সালে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সচেতন প্রতিরোধ প্রচেষ্টাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম।’
প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পথে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সংগঠিত করে বাঙালির ইতিহাসে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ- এই তিনটি নাম সমার্থক হয়ে আছে।
আজ থেকে ৫৮ বছর আগে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। আনুষ্ঠানিকভাবে ’৭০-এর ৭ জুন আমি আওয়ামী লীগে যোগদান করি। ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতির পিতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করার পর তার সান্নিধ্যলাভের দুর্লভ সুযোগ পাই।
ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ধাপে ধাপে জাতির জনক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। যখন তার কাছে থাকতাম তখন তিনি বলতেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই উপলব্ধি করেছিলাম, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই।
একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়েই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছি।’ আজকে শ্রদ্ধাভরে জাতির পিতাকে স্মরণ করে এ কথাই মনে করি, বঙ্গবন্ধু তার দক্ষতা, সাহস, সীমাহীন ত্যাগ আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। জীবনের ৪,৬৮২টি মূল্যবান দিন তিনি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস অবিরাম পরিবর্তন ও বিপ্লবের ইতিহাস। ’৫৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ২২৮টি আসনে জয়লাভ করে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সাম্প্রদায়িকতা বিদায় করার প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
ফলাফল, ’৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ’৫৫-এর ২১ অক্টোবর হয় অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ। দেশের চরম সাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপটকে মাত্র ৬ বছরের মধ্যে আমূল বদলে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ’৫৫তে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জন্ম হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও এর কর্মীগণ একদিনের জন্যও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে নাই। অত্যাচার ও জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে জোরালো প্রতিবাদের ধ্বনি তুলেছিল তারই ফলস্বরূপ জনগণের মধ্যে এসেছিল নব নব চেতনা, নতুন আশা ও উদ্দীপনা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার বজ্র কঠিন শপথ।’
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ‘বজ্র কঠিন শপথ’ চেতনায় ধারণ করে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পথচলা। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ’৬২তে আমাদের স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। ’৬৬-এর ৫ ফেব্র“য়ারি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়েছিলেন লাহোরে। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ’৬৬-এর ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ছয় দফা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলার আসামি করে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করা হয়। জাগ্রত ছাত্রসমাজ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। আমরা ৬ দফাকে হুবহু ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে আসাদ, মকবুল, রুস্তম, মতিউর, আলমগীর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহাসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে ’৬৯-এ প্রবল গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে জাতির জনককে ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে মুক্ত করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করি।
জাতির জনককে ফাঁসির মঞ্চ থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্র“য়ারি মুক্ত করে ২৩ ফেব্র“য়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। এরপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
যখন ১ মার্চ জাতীয় সংসদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়, তখন দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। লাখ লাখ লোক রাজপথে নেমে আসে। শুরু হয় ১ দফা তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেন এবং বজ্র কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বর্তমানে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃত অতুলনীয় এই বক্তৃতাই ছিল মূলত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হাতিয়ার তুলে নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সমাপ্ত করে শপথ করাতাম এই বলে যে, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ, আমরা জানি না। কিন্তু যতক্ষণ তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে আমরা হানাদারমুক্ত করতে না পারবো, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাবো না।’ ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষাধিক শহীদ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়! সেদিন দেশ শত্র“মুক্ত হলেও তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানতাম না। যেদিন ’৭২-এর ৮ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সংবাদ পেলাম, সেদিন সারা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
১০ জানুয়ারি যেদিন তিনি স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন মনে হয়েছে আজ আমরা প্রকৃতই স্বাধীন। এরপর ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আমাকে তার রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন।
দেশ স্বাধীন করেই বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব শেষ করেননি। দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেছিলেন। গোলাঘরে চাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই, রাস্তা-ঘাট-পুল-কালভার্ট সব ধ্বংসপ্রাপ্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত। প্লেন নেই, স্টিমার নেই, কিছুই নেই।
কিন্তু অতি তাড়াতাড়ি তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করেন। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেগুলো ধ্বংস করেছিল সেগুলো পুনঃস্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জনপদ। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
বঙ্গবন্ধুর একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ’৭২-এর ৪ নভেম্বর মাত্র ৭ মাসে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেন। সংবিধান বলবৎ হওয়ার পর গণপরিষদ ভেঙে জাতীয় সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সরকার গঠন করেন।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস্’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে।
আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফরের দিনগুলোর কথা। বিশ্বসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন। প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর।
মুক্তিযুদ্ধের পরম মিত্র প্রতিবেশী ভারতের কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের সামনে অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন। তারপর ১ মার্চ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্র দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছিল। ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন।
কিন্তু সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে সর্বমোট ৬ জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে জীবিত দু’নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যজন মার্শাল জোসেফ ব্রোঞ্জ টিটো। আর প্রয়াত ৪ জন নেতা ছিলেন মিসরের জামাল আবদুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, ঘানার প্রেসিডেন্ট কাউমি নক্রুমা এবং ভারতের পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।
আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ ’৭৩-এর ৯ অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু জাপান সফরে যান। এ সফরে সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল। জাপান সফরের মধ্য দিয়ে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়, তা আজও অটুট রয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে বিশেষ অবদান রেখে চলছে জাপান। ’৭৪-এর ২২ ফেব্র“য়ারি যেদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান সেদিন লাহোর বিমানবন্দরে দেখেছি মানুষ রাস্তার দু’পার্শ্বে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ। লাহোরে এই সম্মেলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
এমনকি যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্য একদিন সম্মেলন স্থগিত হয়েছিল। বিশেষভাবে মনে পড়ে ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কথা। যেদিন জাতির জনক জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ জাতিসংঘে ভাষণ প্রদানের পর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের মহাসচিব-এর সঙ্গে বৈঠক করেন।
এরপর ১ অক্টোবর ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে ৬ দিনের সফরে ’৭৪-এর ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ইরাকের রাজধানী বাগদাদে পৌঁছান। সেখানেও রাষ্ট্রপ্রধানসহ সবাই বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন।
আমরা বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) মাজার জিয়ারতকালে মাজারের খাদেম বঙ্গবন্ধুকে মাজারের গিলাফ উপহার দেন। ’৭৫-এর ২৯ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত জ্যামাইকার কিংস্টনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু রেখেছিলেন তার সরব উপস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর। আজকে যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, তারও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধু- ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে।
সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করেছেন দুটি ভাগে। প্রথমভাগে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়ভাগে আর্থসামাজিক উন্নয়ন। ’৭৪-’৭৫-এ বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয় যা ’৭৩-’৭৪-এর চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি।
কিন্তু ইতিহাসের সত্য হলো তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মুসলিম ভোটাররাই একযোগে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়ে পাকিস্তান নামক কিম্ভূতকিমাকার রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করা বা পাকিস্তান দাবীর বাস্তবায়ন ঘটানোকে সম্ভব করে তুলেছিল। তারপরে মাত্র ২৩ বছর পেরোতে না পেরোতেই, ঐ রাষ্ট্রটিকে সেই একই বাঙালি মুসলিম বিদায় ধাক্কা দিতে গেলেন কেন?
বস্তুত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ সেকালের মুসলিম লীগ নেতারা একটি কথাই শুধু মুসলমান সমাজের মননে মগজে ঢোকাতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তান হলে সেটা হবে মুসলমানদের রাষ্ট্র। আর তা না হলে এবং ভারতবর্ষ যদি অখণ্ড থাকে, তবে মুসলমানরা হিন্দুদের নেতৃত্বাধীনে চলে যাবে।
মুসলিম লীগের এই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির সৃষ্টি হয়েছিল অতীতের হিন্দু, জমিদারদের দ্বারা মুসলিম নিপীড়ন এবং ঐ ইতিহাসকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মুসলিম লীগের উপস্থাপন।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে ঐ ভেদবুদ্ধি ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন নেপথ্য খেলোয়াড় ছিল ইংরেজ শাসকেরা। যারা কিছুতেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে যৌক্তিক মনে করেনি। ভারতবর্ষকে ২০০ বছর ধরে শাসন ও শোষণ করে, ঐ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ নেহায়েত বাধ্য হয়ে ভারতবাসীর স্বাধীনতার দাবি মেনে নিলেও হিন্দু-মুসলিম বিরোধ জিইয়ে রাখে। এতে আখেরে তাদের লাভ হবে মনে করে পাকিস্তান দাবিকে গোপনে উসকে দেয়। সেদিনের সেই সাম্প্রদায়িকতার দগদগে ঘা কী ভারতে, কী পাকিস্তানে, কী বাংলাদেশে- আজও শুকায়নি। বরং দিনে দিনে যেন সাম্প্রদায়িকতা যেন নতুন শক্তি নিয়ে নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে তিনটি দেশেই।।
কিন্তু সেই পাকিস্তানের দাবি যারা বাস্তবায়নে প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করলেন তাঁরা কেন নিজ হাতে ঐ সাধের পাকিস্তানকে বিদায় জানালেন? কেন ঐ কাজে হাজার হাজার মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান আদিবাসী অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন? কেনই বা পাকিস্তানি মুসলিম-হিন্দু লক্ষ লক্ষ অবিবাহিত-বিবাহিত নারী ধর্ষিত হলেন? কেন কোটি কোটি মানুষ লুটপাট, অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ নির্বিবাদে হারালেন?
না, কোনও যাদুমন্ত্র বলে তেমনটি ঘটেনি। বরং অবিশ্বাস্য এ জাতীয় ত্যাগ তিতিক্ষার পশ্চাতে ছিল বাঙালি জাতির সম্মিলিত, ঐক্যবদ্ধ এবং চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতার ঘোষণা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৭ মার্চে প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে জাতির মর্মমূলে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা বলতে বাঙালি জাতি বুঝেছিলো পাকিস্তানি অবাঙালিদেরসহ কোনও দেশি-বিদেশি শাসন, শোষণের হাত থেকে মুক্তি, দ্বিজাতিতত্ত্ব বা তদ্রুপ কোনো তত্ত্বের নামে সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে মুক্তি; অশিক্ষা, কুশিক্ষা, সামাজিক, ধর্মীয়, পশ্চাদপদতার হাত থেকে মুক্তি, নারীর প্রতি তাবৎ বৈষম্যের হাত থেকে ও সকল প্রকার নারী নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি, মানুষে মানুষে যে কোন ধরনের বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি, রাষ্ট্রীয় জীবনে সকল প্রকাশ অগণতান্ত্রিক আচরণের হাত থেকে মুক্তি।
তাই যখন এদেশের মানুষ দেখলো, পাকিস্তানে এগুলির কোনটাই প্রতিষ্ঠা করা যাবে না যখন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বন্ধ করে দিল তখন বাধ্য হয়েই বাঙালি জাতি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মাধ্যমে নয় মাসের যুদ্ধে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলো। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো ষোলই ডিসেম্বর উনিশ শ একাত্তরে লাখো প্রাণের বিনিময়ে।
শুধুই কি সশস্ত্র যুদ্ধের বিজয়? বাঙালি জাতির? পরাজয় হলো তবে কার?
পরাজয় শুধু পাকিস্তানের নয়। পাকিস্তানের তো শোচনীয় পরাজয় হলোই। পাশাপাশি পরাজয় বরণ করল আমেরিকা, চীন ও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির শাসকগোষ্ঠী।
এদেশগুলির পরাজয়ই শুধু নয়, সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্যযোগ্য পরাজয় হলো পাকিস্তানের মৌলিক ভাবাদর্শ- দ্বিজাতিতত্ত্বের। কারণ বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান নির্বিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে। তা স্পষ্টাক্ষরে লিখিত হলো বাহাত্তরের মূল সংবিধানে। এ লক্ষ্যে ঐ সংবিধানে নিষিদ্ধ করা হলো জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলসহ তাবৎ ধর্মাশ্রয়ী দলের।
পরাজিত হলো সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রের এবং তার আদর্শেরও। পরাজিত করে ঐ আদর্শের বদলে লিখিত হলো গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রকে জনগণ এবং একমাত্র জনগণই হবে রাষ্ট্রের মালিক। থাকবে মৌলিক মানবাধিকারগুলির স্বীকৃতি। যেমন কথা বলার স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ ও আইনানুগভাবে সভা-সমিতি, মিছিল-সমাবেশ করার স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা।
বৈষম্যমূলক সকল ভাবাদর্শের নিদারুণ পরাজয়ের সম্মুখীন হলো। নারী পুরুষের বৈষম্য থাকবে না দ্ব্যর্থহীনভাবে- তা লিখিত হলো বাহাত্তরের সংবিধানে। ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতায়, লিঙ্গের ভিন্নতা, বর্ণের ভিন্নতার কারণে কোন নাগরিকের মধ্যে কোন প্রকার বৈষম্যই আইনত গ্রাহ্য হবে না বলে সংবিধানে লিখিত হলো।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি শোষিতের পক্ষে’। বাহাত্তরের সংবিধানে তাই অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে লিখিত হলো সমাজতন্ত্র। এভাবে পুঁজিবাদ হলো প্রত্যাখ্যাত, স্থান করে নিলো সমাজতন্ত্র। উল্লেখ্য, ষাট ও সত্তরের দশকের তরুণ সমাজও লাখো কণ্ঠে সমাজতন্ত্রের অনুকূলে শ্লোগান তুলে সারাদেশের রাজপথ মাঠ-ঘাট প্রকম্পিত করে তুলেছিল।
এহেন একের পর এক অর্জিত বিজয় যেন বিজয়ের বিশাল এক মালা গলায় স্থান করে নিয়েছিল বাঙালি জাতির। সেই বিচ্ছেদের নামই হলো বাংলাদেশ। কবিও তো তাই বলেছিলেন, ‘ বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত’।
কিন্তু না। চিত্রটি যতই গৌরবের হোক, যতই বিজয় অর্জিত হোক হাজারো সাহসী লড়াই এ বাংলাদেশ তা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এ সত্যও অতি অবশ্য স্বীকার্য্য। নিজেই হারিয়ে ফেলছে নিজেকে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখতে পারলো না তার প্রথম সংসদে বাহাত্তর সালে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত সংবিধানটিকে। বঙ্গবন্ধুর ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছিল যে সংবিধানে পরিপূর্ণভাবে। খুনি বলে অভিহিত সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে ঐ পবিত্র সংবিধানটিকে ক্ষত-বিক্ষত করে সংযোজন করলেন ‘বিসমিল্লাহ’, যা অপর কোন মুসলিম সংবিধানেও আজতক স্থান পায়নি। একই অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী বাহাত্তর সংবিধানে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও তা বদলে সেগুলিকে বৈধ ঘোষণা করলেন, তুলে দিলেন সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা শীর্ষক মৌলনীতিও।
বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতির পিতা বিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশটাকে যখন স্বাভাবিক করেছিলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, বাংলার মীরজাফর বেঈমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ওই সময় তার দুই কন্যা আমাদের প্রিয় বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনিচক্র মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ’৮১-এর ১৭ মে বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করে আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশকে আজ অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ষড়যন্ত্র শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে এ দেশের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করার। প্রায় দুই যুগ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় আওয়ামী লীগকে। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ’৯৬-এর ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। জাতীয় ঐকমত্যের সেই সরকারে আমি শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলাম। উন্নয়ন আর অগ্রগতির লক্ষ্যে গঠিত আমাদের সরকারের বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করায় শিল্পোন্নয়ন ও রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
সরকারের ৫ বছরের কালপর্বে দ্রব্যমূল্য ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় মধ্যে। এই সরকারের ইতিহাস সৃষ্টিকারী সাফল্য ’৯৭-এর ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’। আওয়ামী লীগ সরকারের সফল কূটনীতির ফলে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশের দীর্ঘদিনের গঙ্গার পানি বণ্টন সংকটের সমাধান হয়। এ কালপর্বে সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। জাতির জনককে হত্যার পর ঘাতকচক্র পবিত্র সংবিধান কলঙ্কিত করে হত্যাকারীদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। যে কারণে দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিদের বিচার হয়নি। বরং খুনিরা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় পদ, বিশেষ সুযোগ।
’৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। নিম্ন আদালতে হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২১ ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্ত ভিত্তির উপরে দাঁড়াতে শুরু করে। প্রবৃদ্ধির হার ৬.৪ শতাংশে উন্নীত এবং মুদ্রাস্ফীতি ১.৪৯ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ’৯৮-এর জুনে ৯৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার ৫ম এবং বিশ্বের ৯২তম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে ওঠায় সমগ্র দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর সুফল পরিলক্ষিত হয়।
মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই বছরটি সবিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আমরা এখন ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছি। এই একটি কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সুনাম এখন অনন্য উচ্চতায় উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে। মাত্র ৭ বছরের মধ্যে এর বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠে আসবে ও বাকি ৮ বছর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। এর আগে আমরা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার নেশন’ হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের সদস্য হয়েছি। আর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি।
২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত সাড়ে ৯ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই পর্বে জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ভাষায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি চমৎকার। এটা আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়।
নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের ভাষায়, সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক সূচকের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকে এগিয়ে। অনেক বড় বড় প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুতে রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৃথক রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ, মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ সর্বমোট ১১৯টি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩,২০০ থেকে এই ডিসেম্বরে ১৮,০০০ মেগাওয়াট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩.৫ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার, রফতানি আয় ১০.৫২ থেকে ৩৪.৪২ বিলিয়ন ডলার, পায়রাবন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশ করে জনগণের মাথাপিছু আয় ১,৭৬৫ ডলারে উন্নীত করেছেন। সবল-সমর্থ আর্থসামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি।
আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ ২০১৩ নাগাদ বিশ্বের ২৯তম ও ২০৫০ নাগাদ ২৩তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়ে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেবে।’ সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের এসব কৃতিত্বের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত ১৪টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করেছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এত উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে যা এই ক্ষুদ্র লেখায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন নয় বাস্তব। ইতিমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছি।
২০২১-এ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে, তখন আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করব। এগুলো সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে। শেখ হাসিনা যা বিশ্বাস করেন, জাতির জনকের মতো তাই তিনি বলেন এবং বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান তারই অদম্য প্রমাণ। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা করে চলেছেন।
ধীরে ধীরে যেমন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনেক দূর এগিয়ে গেল; সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা সেই পথেই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি।
Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত তথ্যসূত্র : https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1493030.bdnews https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1494538.bdnews