লেখক পরিচিতি
অলক সরকার সাধারণ সম্পাদক ডাবলিন আওয়ামীলীগ আয়ারল্যান্ড।
ছিঃ এরশাদ ছিঃ, করছো তুমি কি গান কবিতা চুরি করে বনেছিলে কবি তোমার গানের সুর আরেকজনের করা আমরা তা জানি ছিঃ এরশাদ ছিঃ, করছো তুমি কি ? ...........
৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এরশাদ সরকার পতনের ৮/৯ মাসের আগে এরকম একটা সময়েই আমি এই কবিতাটা পাঠ করেছিলাম চাঁদপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। এই কবিতাটা বেশ বড়ই ছিল। কিন্তু এখন এতটুকুই মনে করতে পারছি। আমার বাবা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার ছিল তাই সেই সুবাদে বাবার কর্মস্থলের অনুষ্ঠানে যাওয়া। যেহেতু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাই সেখানে সরকারী এই প্রতিষ্ঠানের আরো অন্যান্য উচ্চ পদমপর্যাদার ইঞ্জিনিয়ার সহ তাদের পারিবারিক লোকজন উপস্থিত ছিল।
শিশু মনের ওই সময়ের প্রবল ঘৃণা থেকেই জনসম্মুখে তাও সরকারী কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে সরকার বিরোধী , স্বৈরাচার বিরোধী , এরশাদ বিরোধী এই কবিতা পাঠ করা এই বয়সে এখন মনে হয় ওই কাজটি আসলে দু:সাহসিক-ই ছিল বটে।
এই কবিতা পাঠের পর আমার বাবার বস যিনি নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন তিনি খুঁজতে থাকেন আমি কার ছেলে। আমাকে ডেকে নিয়ে অনেকগুলো চকলেট দেন তিনি। সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে পরে আরো কয়েকবার স্যারদের নির্দেশে আমাকে এই কবিতা পাঠ করতে হয় চাঁদপুরের ষোলঘর প্রাইমারী স্কুলের রিহার্সেল ডে তে। তখন আমি ওই প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র।
এরও আরো কয়েকমাস পর চাঁদপুরে সরকার বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন চাঁদপুর কলেজের ছাত্র রাজু যাকে সমাহিত করা হয় চাঁদপুর কলেজের শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। রাজু শহীদ হওয়ার পর চাঁদপুরের আন্দোলন আরো বেগবান হয়। আমাদের বাড়ির কাছেই রেললাইন থাকার সুবাদে সেই রেললাইন ধরে পুলিশকে অন্যান্য সকলের সাথে রেলের পাথর ও ছুড়ে মেরেছিলাম। ছোটবেলায় আমি খুবই দুরন্ত ছিলাম। বিকেলে বাসা থেকে অনুমতি নিয়ে খেলতে যাওয়ার বাহানায় এরশাদের পেটোয়া পুলিশ বাহিনীকে তখন এক হাত দেখে নেওয়ার পণ ছিল। ওই বয়সে আসলে এতটুকুই ছিল আমার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ।
এরশাদ সম্পর্কে অনেকেই অনেক কিছু জানেন। তার অনৈতিক কর্মকান্ড-ও ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত ও সমালোচিত। যেমন , শহীদ মিনারে ফুল দেয়া বেদাত তার এই ঘোষণার প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবী, কবি সাহিত্যিক, গায়কদের নিয়ে বর্তমানের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট গঠিত হয়।
পটুয়া কামরুল হাসান তাকে " বিশ্ব বেহায়া " উপাধি দেন। তার আঁকা বিখ্যাত স্কেচ ছিল "দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পড়ে"।
নানাকর্মকান্ডে নন্দিত ও নিন্দিত এরশাদ। তার অনেক কিছুই লোক দেখানো , কিছু কাজের ও কিছু বিতর্কিত।আর এই সবকিছুই করা ক্ষমতাকে ধরে রাখার লক্ষ্যে। এরশাদ বিরোধী আণ্দোলন দমনের জন্য পুলিশ বাহিনী মিছিলের উপর ট্রাক উঠিয়ে দিয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তৎকালীন সরকার বিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ প্রায় নয় বছর ধরে শহীদ হন অনেকেই।
শুধু তাই নয়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চট্রগ্রামে এক জনসভায় পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলা হয় শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানব বর্ম তৈরী করা ছাত্রলীগের কর্মীদের। ওই সময়ের জাতীয় পার্টির নেতা ও মন্ত্রী কাজী জাফর ওরফে বিশিষ্ট চিনি চোর, কুখ্যাত রাজনীতি বিদ শাহ মোয়াজ্জেম ও মওদুদরা সহ এই সব অভিশপ্ত রাজনীতিবিদদের অনেকের হাতেই রক্তের দাগ লেগে আছে। এরকমই আরো অনেক ছিল তাদের কুখ্যাত কর্মকান্ড।
৯০ এর গণআন্দোলনে এরশাদ সরকার উচ্ছেদের মাধ্যমে দেশের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো ঝেঁকে বসা সেই জিয়ার আমল থেকে শুরু করে একযুগের ও বেশি সময়ের অবৈধ সামরিক শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে।পতিত এই স্বৈরাচার পরবর্তীতে বিএনপির রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অতি লোভের কারণে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ কে পরাজিত করার লক্ষ্যে বিএনপি- জামায়েত সহ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে জোট গঠন করে। সেখানে তারা সরকার গঠন করলেও দেশ এক ব্যর্থতার অমানিশায় নিমজ্জিত হয়। পাকিস্তানপন্থী বিএনপি জামায়েত পাকিস্তানের আদলে এক জঙ্গি গোষ্ঠী নির্ভর দেশ গঠনের দিকে মনোযোগ দেয়। দেশের উত্তরবঙ্গে দেখা দেয় মঙ্গা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ,আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যা নিয়ন্ত্রণে খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে অপারেশন ক্লিনহার্ট করতে হয়, সেখানে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয় জঙ্গিদের উপদ্রব, দেশকে বিরোধী শূন্য করার চক্রান্ত , আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা , আদালত চত্বর সহ সবখানেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের মতো বোমাবাজি চলতে থাকে।
দেশের অবস্থা এতটাই খারাপ পর্যায়ে চলে যায় যে এরশাদের শাসনকাল এই সব কিছুর কাছেই তুচ্ছ মনে হয়। বিএনপির শাসনকাল শেষে তারা আবার সুষ্ঠ নির্বাচন দিতে টালবাহানা করতে থাকে।
পরবর্তীতে, বিএনপি জামায়াতের এই অপশাসন থেকে মুক্তির লড়াইয়ে এরশাদকে সাথে নিয়ে দূরদর্শী আওয়ামীলীগ জোট গঠন করে এবং বিপুল ভোটে আওয়ামীলীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে। যারা ২০০১-২০০৬ বিএনপির এই শাসনামল দেখেছেন তারা জানবেন কিরকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ছিল দেশ। যদি ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ পরাজিত হতো তাহলে হয়তো আজকে আমাদের পাকিস্তানীদের মতো বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় দিতেই লজ্জাবোধ হতো।
দেশের সেই দু:সময় উত্তরণে জাতীয় পার্টি প্রধান এরশাদ গণতান্ত্রিকভাবে মহাজোট গঠনে আওয়ামীলীগের সাথে আসায় ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কারণ দিন শেষে, এখন তিনিও একজন গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ।